বসন্তপঞ্চমীর বিদায়বেলায় মর্ত্য ছাড়লেন কোকিলকণ্ঠী।   

সরস্বতী যাঁর কন্ঠে বিরাজ করতেন বসন্ত পঞ্চমীর বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে মর্ত্য ছাড়লেন সেই সঙ্গীত লতা মঙ্গেশকর। রবিবার সকালে ব্রীচ ক্যান্ডি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সঙ্গীত সম্রাজী। মুম্বাইয়ের শিবাজী পার্কে তাঁকে শেষবারের মত শ্রদ্ধা জানান তাঁর বিপুল সংখ্যক ভক্তবৃন্দ। বছরখানেক ধরে বেশ কয়েকবার শারীরিক অসুস্থতার কারণে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল প্রয়াত শিল্পী কে। নিজেই টুইট করে ভক্তদের আশ্বাসবাণী জানাতেন। ফিরেও আসতেন নিজঘরে, কিন্তু শেষবারে করোনার কাছে হার মানলেন তিনি। মাসখানেক আগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ব্রীচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। মাঝেমাঝেই শরীর জবাব দিতে চাইছিলো তাঁর। যার জন্য ভেন্টিলেশন জরুরি হয়ে পরেছিল। তাঁর শারীরিক অবস্থার ফেরে বারবার ভেন্টিলেশন থেকে আনা নেওয়া করছিলেন চিকিৎসকেরা। শনিবার পুনরায় তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ভেন্টিলেশনে নিতে হয় তাঁকে। শনিবার তাঁর বোন আশা ভোঁসলে দিদি কে দেখে এসে জানিয়েছিলেন ভালো আছেন কিন্নরকণ্ঠী। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না। তাঁর মৃত্যুতে টুইট করে শোকপ্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন কিংবদন্তি শিল্পীর মৃত্যু তে। মাল্টি-অর্গ্যান ফেলিওরের কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এদিন সকালে তাঁর বোন সঙ্গীতশিল্পী ঊষা মঙ্গেশকর এই দুঃসংবাদটি সংবাদ-মাধ্যমকে জানান। 'ভারতের নাইটিঙ্গেল' লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে দেশ জুড়ে। শোকপ্রকাশ করেছেন দেশের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় প্রমুখ। এই কিংবদন্তী শিল্পীর প্রয়াণে দু-দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে ভারত সরকার। এই দু-দিন সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানে অর্ধনমিত রাখা হবে জাতীয় পতাকা। মঙ্গলবার অর্ধদিবস ছুটি ঘোষণা করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। লতা মঙ্গেশকরের জন্ম ১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে। তাঁর পিতা দীননাথ মঙ্গেশকর ছিলেন মারাঠী ও কোঙ্কনী সজ্ঞীতজ্ঞ এবং মঞ্চ অভিনেতা। তাঁর মা সুধামতী দেবী ছিলেন গুজরাতি। লতা মঙ্গেশকরের বয়স যখন মাত্র ১২ বছর, তখন মারা যান তাঁর বাবা। তাঁর তিন বোন আশা, ঊষা ও মীনা এবং এক ভাই হৃদয়নাথকে নিয়ে প্রবল জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন লতা মঙ্গেশকর। পরবর্তী কালে বোন আশা ভোঁসলেও সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে ঊষা মঙ্গেশকরও যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন। অন্য বোন ও ভাই হদয়নাথ মঙ্গেশকরও সঙ্গীতের সঙ্গেই যুক্ত। ভারতের ৩৬টি ভাষায় এবং প্রায় ৩০ হাজার গান গেয়েছেন এই জীবন্ত কিংবদন্তী। বিগত পঞ্চাশের দশকের শেষ ভাগ থেকে বাংলা গানের সঙ্গে গড়ে ওঠে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ। তিনি শিক্ষক রেখে বাংলা পড়তে ও লিখতে শিখেছিলেন। বাংলা আধুনিক ও চলচ্চিত্রে গাওয়া তাঁর গানগুলি বাঙালি শ্রোতারা কোনোদিন ভুলবেন না। তিনি একাধিকবার পেয়েছেন ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড, ফিল্ম ফেয়ার আজীবন সম্মাননা। পেয়েছেন ভারত সরকারের পদ্মডূষণ, পদ্মবিভূষণ, দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার এবং ২০০১ সালে পেয়েছেন ভারতরত্ন। ২০০৭ সালে ফ্রান্স সরকার তাঁকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা লেজিওঁ দ্যনর-এ ভূষিত করেন। সঙ্গীত সম্রাজ্ঞীর প্রয়াণে শোক প্রকাশ করেছেন বাংলার সঙ্গীত জগতের বিশিষ্টজনেরা। পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী বলেছেন, 'লতাজীর সঙ্গে আমার বহু বছরের সম্পর্ক। তিনি যখন দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পান, সেই অনুষ্ঠানে আমি পাই শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব গায়কের পুরস্কার। তাঁর বাবার নামাঙ্কিত 'দীননাথ মঙ্গেশকর পুরস্কার' তিনি দিয়েছিলেন আমাকে এবং পরে আমার কন্যা কৌশিকী-কেও। কলকাতায় যখন তাঁকে শ্রেষ্ঠ সজ্ঞীতজ্ঞের সম্মাননা দেওয়া হয়, সেই পুরস্কার আমি তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলাম। তাঁর কাছ থেকে শিখেছিলাম কীভাবে মাইক্রোফোনে শ্বাস নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। আমার মা, স্ত্রী, কন্যা সবার সঙ্গেই তাঁর খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। আমি দু-জন শিল্পীকে সর্বোচ্চ আসনে রেখেছিলাম। একজন এম এস শুভলক্ষ্মী আর অন্যজন লতা মঙ্গেশকর। তাঁর এ স্থান পূর্ণ হওয়ার নয়।' ওস্তাদ রশিদ খান বলেন, 'বহু স্মৃতি মনে পড়ছে। কীভাবে নিখুঁত সুরে গলা রাখতে হয়, তা লতাজীর কাছে শিক্ষণীয়। গোড়ায় আমি এক শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে গেয়েছিলাম। সামনের আসনে বসেছিলেন লতাজী। অনুষ্ঠানের পরে তিনি নিজে এসে আমার খুব প্রশংসা করেছিলেন। একবার তিনি আমাকে একটি ভজন শিখিয়ে দিয়েছিলেন। সেইসব কথা খুব মনে পড়ছে।' 'কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই'-- এই বিখ্যাত গানের সুরকার সুপর্ণকান্তি ঘোষ বললেন, 'বটগাছটা আর নেই। মাথার ওপরে শুধু আকাশ, মাঝখানে আর কিছু নেই। খুব খারাপ লাগছে। আমার জন্মের আগে আমার বাবা নচিকেতা ঘোষের সুরে লতাজী গান গেয়েছিলেন 'অসমাপ্ত' ছবিতে। কিন্তু কোনো টাকা নেননি তিনি। সেজন্যে বাবা তাঁকে একটা রুপোর বীণা উপহার দিয়েছিলেন। 'অসমাপ্ত' ছবিতে বাবার সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া 'কাঁদল কেনে মন রে' খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। বম্বেতে হেমন্তকাকু আমাকে একবার লতা মঙ্গেশকরের পেডার রোডের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু লতাজীর সঙ্গে দেখা হয়নি। বেরিয়েছিলেন কোথাও। মেহমুদ তাঁর জন্যে বসেছিলেন। লতাজীর ঘরে হেমন্তকাকু দেখালেন বাবার দেওয়া সেই রুপোর বীণা। তাঁর মৃত্যুতে আমার খুব খারাপ লাগছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন