৮৮ বছর পর ২০২০ সালে করোনার গ্রাসে বন্ধ মহিষাদলে রথ উৎসব।

একসময় ১৯৩২ সালে ব্রিটিশদের অত্যাচারের প্রতিবাদে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ঐতিহ্য প্রাচীন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মহিষাদলের রথযাত্রা। এর ৮৮ বছর পর এবার করো না আতঙ্কে বন্ধ মহিষাদলের রথযাত্রা। যার ফলে রথ প্রেমী মানুষের মনে উৎসবের আনন্দে ভাটা পড়েছে। তবে রথের চাকা না ঘুরলে রাজ পরিবারের পক্ষ থেকে পালন করা হবে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান। শুক্রবার মহিষাদল পঞ্চায়েত সমিতির প্রেক্ষাগৃহে এক প্রশাসনিক বৈঠকের মাধ্যমে ঠিক করা হয় জমায়েত এড়ানোর জন্য বন্ধ রাখা হচ্ছে মহিষাদলের প্রাচীন রথযাত্রা উৎসব। 

মহিষাদল পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি তিলক চক্রবর্তী জানান, করোনা ভাইরাসের হাত থেকে সমাজকে বাঁচাতে হলে জমায়েত কমাতে হবে। আর জমায়েতের কথা মাথায় রেখে স্থানিয় প্রশাসন, মানুষজনের অনুমতি ক্রমেই এবছর রথ বন্ধ রাখা হচ্ছে। বহু মানুষ আনন্দ উপভোগ, ব্যবসা- বানিজ্য থেকে বঞ্চিত হলেও বাধ্য হয়ে আমাদের এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। রাজ পরিবারের সদস্য হরপ্রসাদ গর্গ জানান, প্রশাসনিক নিয়ম মেনে এবছর মহিষাদলের প্রাচীন রথ টানা হবে না। তবে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান পালন করা হবে। শিক্ষাবিদ হরিপদ মাইতি ও অর্নব রায় জানান, এর আগে ১৯৩২ সালে ব্রিটিশদের অত্যাচারের কারনে মহিষাদলের রথ টানা বন্ধ থাকে। ৮৮ বছর পর আবার করোনার কারনে মহিষাদলের প্রাচীন রথ টানা বন্ধ থাকছে। ফলে মনে বিষাদ জমা হলেও মেনে নিতে হবে সমাজের ভালোর জন্য।
ইতিহাস ঘাঁটলে জানাযায়, রাজা আনন্দলাল উপাধ‍্যায়ের সহধর্মিণী ধর্মপ্রাণ রানী জানকি দেবী মহিষাদলের রথের সূচনা করেছিলেন। এরপর ১৮০৪ সালে ওই রানীর মৃত্যুর পর অল্পকালের জন্য মতিলাল পাঁড়ে মহিষাদলের রাজত্ব পান।সেই সময় তিনি একটি সুন্দর ধরনের সতেরো চূড়োর রথ তৈরি করান। পরে ১৮৫২ সালে ততকালীন রাজা লছমন প্রসাদ গর্গ বাহাদূর ওই সতেরো চূড়ো রথের সংস্কার করার জন্য কোলকাতা থেকে কয়েকজন চীনা কারিগরকে অনিয়েছিলেন। সে সময় প্রায় চার হাজার টাকা খরচ করে তিনি রথের চারধারে চারটি মূর্তি বসিয়েছিলেন। ১৯১২ সালে স্হানীয় মিস্ত্রি মাধব চন্দ্র দে রথের সামনের কাঠের ঘোড়া দুটিকে তৈরি করেছিলেন।যা এখনও পর্যন্ত রথ বিগ্রহের মধ্যে দেখা যায়।রথের মধ্যে এখন সেকালের তৈরি ঘোড়া থাকলেও এখন আর সেকালের সেই সতেরো চূড়োর রথ আর নেই।এখন মহিষাদলের রথ তেরো চূড়োয় পরিণত হয়েছে।সেকালের সতেরো চূড়োর রথের একএকটি চাকার উচ্চতা ছিল প্রায় ৬ ফুটের বেশি।এখন যা ৪ ফুটে এসে দাঁড়িয়েছে।এখানকার রথের মোট চাকার সংখ্যা ৩৪টি। পুরী,মাহেশের পরই ঐতিহ‍্যের দিক থেকে উঠে আসে মহিষাদলের রথের কথা। তবে গত বেশকয়েকবছর ধরে এই মহিষাদলের রথের অবস্থা খুব করুন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। আগে সমগ্র জেলাজুড়ে এই মহিষাদলেই একমাত্র রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হত। বছরের পর বছর এগালেও এখনও সেই আগের মতোই থেকে গেছে রথের প্রাচীন রীতিনীতি। প্রাচীন রীতি মেনেই এখনও রথের আগের দিন ঘটা করে পালন করা হয় লেত উৎসব। রাজ পরিবারের সদস্যদের উপস্হতিতে রথে স্হাপন করা হয় রাজকীয় কলস এবং রথে বাঁধা হয় কাছি। মহিষাদলের রথের এক অন‍্যতম বৈশিষ্ট্য হল এখানকার রথে চড়ে যান রাজপরিবারের কূলদেবতা শ্রী গোপাল জিঊ এবং তাঁর সাথে যান জগন্নাথদেব।তবে যাননা বলরাম ও সুভদ্রা। রথে চড়ে গোপাল জিঊ ও জগন্নাথদেব যান প্রায় এক কিলোমিটার দূরে গুন্ডিচাবাটিতে নিজের মাসির বাড়িতে। সেখানে একসপ্তাহ ধরে নিজের মাসিরবাড়িতে আদরযত্ন খাওয়ার পর ফেরত রথের দিন রথে চড়ে আবার ফিরে আসেন গোপাল জিঊ ও জগন্নাথদেব। রাজাদের আগেকার মতো সেই শাসন ব্যবস্থা এখন আর নেই। কিন্তু রয়েছে বেশ কিছু প্রাচীন রীতি। রথের দিন রাজপরিবারের কোনো সদস্য রথের রশিতে টান দেওয়ার পরই শুরু হয় রথ টানার কাজ। এরপর রথের সারথির নির্দেশ মেনে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে গুন্ডিচাবাটিতে মাসির বাড়িতে পৌঁছায় রথ। রথে আগে রাজার সঙ্গে যেত হাতী, ঘোড়ার মতো নানাবিধ কিন্তু এখন সেসব না গেলেও পালকি চড়ে আগের সেই রীতি মেনে রথের রশিতে টানা দিতে যান রাজারা। এখানকার রথ টানতে উপস্থিত হন জেলার প্রায় কয়েকলক্ষ দর্শনার্থী। তবে এবছর মহিষাদল এর রথ এর সেই যাতে না নামে সে ব্যাপারে তৎপর থাকবে প্রশাসন। ইতিমধ্যে প্রশাসনের তরফ থেকে মহিষাদলের বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং প্রচারের মাধ্যমে জানানো হচ্ছে মহিষাদলের প্রাচীন রথযাত্রা বন্ধের কথা।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন