কণাদ দাশগুপ্ত
দেউটি একে একে সবই প্রায় নিভে গিয়েছে। দেশের রাজনৈতিক মহাকাশের উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্করা প্রায় সবাই অস্তাচলে। কোনও এক রাজনৈতিক চরিত্রের প্রয়াণের পর, গোটা দেশের আঁখি সজল হয়, অটল বিহারী বাজপেয়ীর পর এমন চরিত্র এ দেশে এখন আর নেই। এখন মাঝে মধ্যে ‘টেলর-মেড’ কিছু শোক হয়তো দেখা যায়, কিন্তু বাজপেয়ীজির পর কারও বিয়োগে গোটা ভারত এক সুরে কাঁদবে, এমন চরিত্র আর নেই। হবেও না।
শারীরিক কারনেই বাজপেয়ীজি স্বেচ্ছানির্বাসনে ছিলেন শেষের দিনগুলিতে। খবরেরও বাইরে ছিলেন। শিরোনামে আজ তাঁরই দলের নতুন নক্ষত্ররা। বাজপেয়ীজির খবর না জানতে জানতে কখন যেন তাঁকে ভুলেই গিয়েছিলো ভারতবর্ষ। 2018 সালের 16 আগস্ট, দিল্লির AIIMS-এ বিকেল 5.05 মিনিটে তাঁর মৃত্যুই তাঁকে সাময়িক ফিরিয়ে এনেছিলো রাজনীতি আর খবরের মঞ্চে। দু’দিন পর ফের বিস্মৃতির অতল গহ্বরে অটল বিহারী।
ক্রমশই বিবর্ণ হচ্ছে ভারতীয় রাজনীতির বর্ণময় চালচিত্র। বিরোধী নেতা হিসাবে উজ্জ্বল কয়েক যুগ অতিক্রম করার পর অটল বিহারী বাজপেয়ী প্রবেশ করেছিলেন ক্ষমতার অলিন্দে। সেখানেও নিজের কীর্তিতে একঝাঁক লিলিপুটের মাঝে হয়ে উঠেছিলেন গালিভার। “তাঁর থেকেও আমি বড়”, কেউ কেউ এমন একটা ভাব দেখাতে চাইছেন বটে, কিন্তু দলমত নির্বিশেষে দেশের মানুষ জানেন অটল বিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে তুলনা করতে হলে আর একটা অটল বিহারী’কেই দরকার। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক মঞ্চে তেমন চরিত্র এই মুহূর্তে কোথায় ? তাই সে চেষ্টা হবে নির্বোধের চেষ্টা।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর অটলজি প্রকাশ্যে বলেছিলেন,”If Advaniji did not want, I would never have been Prime Minister.” ইদানিংকালে দেশের বা কোনও রাজ্যের কোনও শীর্ষতম চরিত্র এমন কিছু কখনও বলতে পেরেছেন ? কখনও এভাবে স্বীকার করেছেন যে তাঁকে ক্ষমতাসীন করতে কত মানুষের কান্না-ঘাম-রক্ত লেগেছে ? বাজপেয়ীজি কম বড় নেতা ছিলেন না। এমন একটা ধারনা ওনার থাকতেই পারতো, ওনার জন্যই বিজেপি এতখানি প্রভাবশালী হয়েছে, ক্ষমতায় এসেছে। ওনার ছবিতেই ভোট হয়। ভাবতেই পারতেন, দলে উনিই একমাত্র স্তম্ভ। এখন তো এমন ভাবনা-ই রাজনৈতিক নেতাদের কালচার। কেউ নিজেই এসব বলেন, কেউ আবার ঘনিষ্ঠ স্তাবক- বৃত্তকে এ কাজে লাগান। এক মুহূর্তের জন্যও বাজপেয়ীজি এমন ভাবেননি। তিনি বলেছিলেন, ” I am contesting elections since 1952, but never did I throw mud.” এখন তো এসব কথা রূপকথা। নেতা-নেত্রীরা তো এখন মঞ্চেই ওঠেন দু-চার ড্রাম পাঁক নিয়ে। বিপক্ষের দিকে ছুঁড়তে গিয়ে নিজের গায়েও মেখে নেন। তাতেই বা কোন মহাভারত অশুদ্ধ হচ্ছে। আমরা হাততালি দিচ্ছি, দাদা-দিদির নামে স্লোগান তুলে আকাশে চিড় ধরিয়ে দিচ্ছি। কাদা মাখা চরিত্রকেই দেশের মসিহা ভাবছি।
তিনি বলেছিলেন, “My government is committed to carrying out electoral reforms. It is our firm resolve to keep criminal elements away from power.” এসব কথা এখন ইতিহাসের পাতায়। কোনও দলের শীর্ষনেতা এখন এসব ভাবলে, পদ খোয়াতে হবে। রাজনীতিতে ‘দুর্বৃত্তায়ন’ সংস্কৃতিটাই এখন ট্রেণ্ডি। একদিন তিনি বলেছিলেন, “The BJP regards Muslims as Indians and human beings”,বলেছিলেন, “I would like that no citizen of the state feels alone and helpless. The entire nation is with them”। স্মৃতিভ্রংশতা বোধহয় আশীর্ব্বাদ হয়ে এসেছিলো তাঁর শেষজীবনে। জানা নেই, তিনি আদৌ জানতেন কিনা, 2014 থেকে তাঁর দলের হাতেই দেশের শাসনভার। অজানা থেকে থাকলেই ভালো। নাহলে, হাজারো দীর্ঘশ্বাস নিশ্চিতভাবেই তাঁকে বেদনাহত করতো।
সুতরাং বাজপেয়ীর পাশে কাকে বসাবেন ? পাশে তো দূরের কথা,পাঁচ-দশটা সারি পিছনেই বা কাকে বসাবেন? তাই বাজপেয়ীজি অ-তুলনীয়। বাজপেয়ীজির বিদায়বেলায় দেশের রাজধানী ভেঙ্গে পড়েছিলো দেশের ‘শ্রেষ্ঠ’ নেতা-নেত্রীদের ভিড়ে। সবাই “অন্তরের অন্তঃস্থল” থেকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন ভারতের এই রত্নকে। একইসঙ্গে শুরু করেছিলেন একটা সূক্ষ্ণ প্রতিযোগিতা, কার সঙ্গে এই প্রবাদপ্রতিম প্রয়াত নেতার ‘অত্যন্ত সুসম্পর্ক’ ছিলো তার প্রমানে। নেতা-নেত্রীদের অবান্তর কথার ফুলঝুরি ছুটেছিলো টিভির পর্দায়। সত্যি সত্যিই অটল বিহারী বাজপেয়ীজির পদাঙ্ক অনুসরন করার যোগ্যতা এদের ক’জনের আছে, দেশের মানুষ তা জানেন।
রাজনীতিতে আজ বোধহয় দেখানোর ‘খেলা’ই বেশি চলে। এক পরিকল্পিত কৃত্রিমতা দেশের রাজনীতির আগাপাশতলা ঢেকে দিয়েছে। বাজপেয়ীরা এ যুগে অচল। পুজোর ছলে আমরা বোধহয় এই মানুষটিকে ভুলেই থাকতে চাই।
এভাবে ভুলে থাকাই হোক তাঁর প্রতি শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধার্ঘ।