লাথির ঢেঁকি চড়ে ওঠে না।

মিহির গঙ্গোপাধ্যায়

কোনও না কোনও শাস্ত্রে নিশ্চয় লেখা আছে, লাথির ঢেঁকি চড়ে ওঠে না। যে সব মাথামোটা গাড়োল লোক পথ নিরাপত্তা আইন ভাঙে তাদের সম্পর্কে এই শাস্ত্রীয় অনুশাসনটি প্রযোজ্য। এইসব ক্রিমিনাল নিজেদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে। অন্যের বিপদের কারণ হয়। আইনশৃঙ্খলার সমস্যা সৃষ্টি করে।

এদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের রাজপুত্তুর বা নবাবপুতুর ভাবে। তাই পথ নিরাপত্তা আইন ভেঙে ধরা পড়লে কয়েকটা টাকা জরিমানা দিতে তাদের কষ্ট হয় না। যাতে সত্যই কষ্ট হয় তার জন্য কী করা দরকার তা ওই শাস্ত্রবাক্যে বলা হয়েছে।

এটা সামাজিক আপদ। এদের একটি বড় অংশই বাপ দাদার ঘাড় ভেঙে একটি মোটরবাইক পেয়েছে। তাই নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। হেলমেট পরার বালাই নেই, এক বাইকে তিনটে সওয়ারি। গতিবেগ লাগাম ছাড়া, পুলিশকে কুছ পরোয়া নেই। একটা চালান ধরিয়ে বা কিছু টাকার জরিমানা করে এদের গরম ভাঙা যাবে না। এসবও থাক, সেই সঙ্গে যোগ হোক ওই দাওয়াই লাঠৌষধি। এটা আমার চাওয়া নয়, শাস্ত্রীয় নির্দেশ। এখন চোখকান খোলা থাকলে জানা যাচ্ছে, এই দুরাত্মারা বাইক দাবিয়ে, মহিলাদের অসম্মান করছে, ছিনতাই করছে, পুলিশকে ধরে পেটাচ্ছে। তাদের মদত দিয়ে পুলিশকে বেকায়দায় ফেলতে কিছু বিশ্ববখাটে বাউন্ডুলে মস্তান জুটে যাচ্ছে। এদের এই দুঃসাহস সমাজের পক্ষে বিপদ।

এমনও জানা যাচ্ছে, এদের সঙ্গে গান্ধিগিরি করার জন্য কিছু ন্যাকা লোক বেরিয়ে পড়ছে। তারা আইনভঙ্গকারীদের ভৎসনা না করে গোলাপ ফুল দিচ্ছে। হেলমেট বিতরণ করছে। গান্ধি বা গণতন্ত্র বা আইন কোথায় বলেছে, ক্রিমিনালদের উপযুক্ত দাওয়াই না দিয়ে। গোলাপ ফুল দিতে হবে বা হেলমেট বিতরণ করতে হবে? কেউ বলেনি, কোথাও এমন অদ্ভুত কথা বলা নেই। তবুও গান্ধিগিরির নামে এই নষ্টামি সহ্য করা হচ্ছে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নতুন ইনিংস আরম্ভ করেছে। এই সরকার পত্তনি ইনিংসে এমন কিছু ব্যবস্থা নিয়েছিল যেগুলি বিতর্কিত। সেগুলি নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। প্রতিবাদও হয়েছে।

এবার সরকারে এসেই তারা দেরি না করে সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থা আঁটোসাঁটো করার জন্য একটি বড় লাফ দিয়েছে। গত পাঁচ বছর ধরে সেই চেষ্টা চলছিল। নানা বাধায় এতদিন তা এগোতে পারেনি। গত ১৫ জুলাই লোকসভায় এই সম্পর্কে একটি বিল গৃহীত হওয়ায় সেই বাধাটি দূর হয়েছে। তার পরিচয় মোটর যান (সংশোধনী) কিল, ২০১৯।

পদব্রজে বা যানবাহনে চলাচল সাধ্যমতো নিরাপদ করার জন্য বিলটিতে শাক্তিমূলক ব্যবস্থায় খানিকটা কড়াকড়ি করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য সাধু ও সমর্থনযোগ্য। কিন্তু ওষুধের ডোজ যতটা কড়া করার দরকার ছিল ততটা হয়নি। মনে হয় সরকার বেশি ঝুঁকি নেওয়ার সাহস পায়নি। বিলের ব্যবস্থাগুলি জনস্বার্থে মিডিয়ায় এবং কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের ব্যাপক ও বিস্তারিতভাবে প্রচার করা দরকার ছিল। দুঃখের বিষয় তেমনটা হয়নি। যেটুকু সংবাদ মিডিয়া প্রকাশ করেছে তাতে বোঝা যাচ্ছে না বিরোধীপক্ষ এই ব্যাপারে কী ভূমিকা নিয়েছিল। তারা বিলটি সমর্থন করেছিল, নাকি বিরোধিতা করেছিল, নাকি বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করতে বিলটির কতিপয় ধারার সমালোচনার জন্য নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছিল।

তারা বিলটির বিরোধিতা করে থাকলে উচিত কাজ করেনি। বিলের সমালোচনা করা অবশ্য ততটা আপত্তিজনক নয়। বরং সংসদীয় গণতন্ত্রের শিরদাড়াই সমালোচনা। বিধানসভায় বা সংসদে বিরোধীদের জন্য জায়গা থাকা বা তাদের কণ্ঠস্বর অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া অবশ্যই দরকার। তা না থাকলে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রহসনে পরিণত হয়। যারা চোখ খুলে রাস্তা চলেন তাদের বলে দিতে হয় না যে দু’চাকা, চার চাকা এবং তারও বেশি চাকার যানবাহনের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। ফলে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যাও উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌছে যাচ্ছে। যে কোনও দায়িত্বশীল সরকারের উচিত এই বিপজ্জনক প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করে পথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। কেন্দ্রীয় সরকার এই সংশোধনী বিলটি এসে সেই দায়িত্বই পালন করেছে। এই আলোচনায় আরও অগ্রসর হওয়ার আগে মনে রাখা দরকার, পথ দুর্ঘটনায় কেবল পথচারীর মৃত্যু হয় না, বিভিন্ন গাড়ির চালক ও সওয়ারিরও প্রাণ যায়। গাড়ির চাবি হাতিয়ে নিয়ে নেহাতই কোনও নাবালক পথে বেরিয়ে পড়ল এবং বেসামাল হয়ে গাড়ি চাপা দিয়ে কাউকে মেরে ফেলল বা জখম করল। মাতাল হয়ে গাড়ির চালকের আসনে বসে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে সেই বেহেড লোকটা, তার সহযাত্রীরা তো মরুল বা জখম হল, সেই সঙ্গে দু’একজন নির্দোষ পথচারীও প্রাণ হারাল। বিনা হেলমেটে মোটরবাইক ছুটিয়ে মৌজমত্তি তে বেরিয়ে কোথাও ধাক্কা লাগিয়ে মাথা চৌচির হয়ে মৃত্যু ঘটল। ব্রেক ফেল করে দুর্ঘটনা ঘটল এবং জীবনহানি ঘটল।

এগুলি দুর্ঘটনা। সেই সঙ্গে গুরুতর অপরাধও। ধরুন, যে নাবালক কাঁপা হাতে স্টিয়ারিং ধরে হয় সে নিজে অকালে মারা গেল অথবা অন্য কারও জীবন নিল। সে তো শাস্তিযোগ্য অপরাধ করল। কিন্তু গাড়ির মালিক বা তার অভিভাক কী করছিল? এইরকম ক্ষেত্রে মালিক বা অভিভাবকও রেহাই পেতে পারে না। আইন তাই বলেছে। | এতক্ষণে হচ্ছিল বিল নিয়ে আলোচনা। হঠাৎ এসে গেল আইন। অভয় দিচ্ছি, এতে বিভ্রান্তির কারণ নেই। কারণ যে আইনটি সংশোধন করার জন্য এই বিলটি আনতে হয়েছে সেটি ৩১ বছরের পুরনো। ১৯৮৮ সালে আইনটি চালু হয়েছিল। তারপর এতগুলো বছর কেটে গেছে। এই সময়ের মধ্যে জনসংখ্যা বেড়েছে, গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে, রাস্তা বেআইনি দখলের ফলে অপরিসর হয়েছে। ফলে ফুটপাথ-বঞ্চিত পথিককে বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমে আসতে হয়েছে। এই সব পরিবর্তন বিবেচনা করে আইনটি যুগোপযোগী করার দরকার ছিল। সেই কারণেই এই সংশোধনী বিলটি আনা হয়েছে। অপরাধ অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা আইনটির মূল কাঠামো। ৩১ বছর আগে যে শাস্তি যথেষ্ট মনে হতে পারত, এখন তা মনে হবে যথেষ্ট নয়। সুতরাং প্রতিটি অগ্রাধের ক্ষেত্রে শাস্তির ডোজে বৃদ্ধি করা দরকার ছিল। সংশোধনী এনে সেটাই করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বর্ধিত শাস্তির কয়েকটি দৃষ্টান্ত (বন্ধনীর মধ্যে) যা ছিল ; | বিনা হেলমেট (১০০ টাকা)- ১০০০ টাকা, মাতাল চালক (২০০০ টাকা) -১০০০০ টাকা, নাবালক অপরাধীর অভিভাবক – ২৫০০০ টাকা তৎসহ তিন বছর কারাদণ্ড এবং গাড়ির রেজিস্ট্রেশন বাতিল, দু’চাকার গাড়িতে দুজনের অতিরিক্ত সওয়ারি (১০০ টাকা)- ২০০০ টাকা ইত্যাদি।

যে কোনও আইনভঙ্গকারী ক্রিমিনাল শক্তির যোগ্য। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী তা লঘু বা গুরু হতেই পারে। কিন্তু পথ নিরাপত্তা ভঙ্গকারী ক্রিমিনাল কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে বা আরও বড় দল নিয়ে কর্তব্যরত পুলিশের গায়ে হাত তুলেও পার পেয়ে যাচ্ছে। এটা চলতে দেওয়া যায় না। এইসব ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক সাজা ছাড়া এই ব্যাধি নিরাময় হবে না।

আমি যদি কোনও রাজ্যের রাজ্যপাল হতাম তো বলে দিতে পারতাম, পুলিশের ওপর হামলাকারীদের পিটিয়ে ছাতু করা প্রাথমিক ব্যবস্থা। তা বলতে পারছি না এটাই অসুবিধা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন