নিজস্ব প্রতিনিধি— কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়। তার মধ্যে ইদানিং ভোটরঙ্গের ছড়াছড়ি এই বঙ্গে। স্লোগানে কিংবা গানে, বাড়ির দেওয়ালে কিংবা ফেসবুক ওয়ালে ভোটের ব্যঙ্গচিত্র।
রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে কার্টুন তৈরি থেকে রাজনৈতিক দলের হয়ে নানান ধরনের ছড়ায় দেওয়াল লিখন এখন রীতিমতো চর্চার বিষয়। অবশ্য এই রেওয়াজ নতুন নয়। বহুযুগ আগে শরৎচন্দ্র পণ্ডিত তথা দাদাঠাকুর ভোটকে রচনা করেছেন ভোটামৃত বা ভোটাভিনন্দন নামে উপাদেয় রসসাহিত্য।
এখন সোশ্যাল নেটওয়ার্কের বাড়বাড়ন্ত। তাই ভোট নিয়ে কথা বা সুর যা-ই বাঁধা হোক তা নিমেষে ছড়িয়ে পড়ছে সকলের কাছে। দেওয়ালের পোস্টারই হোক কিংবা ফেসবুকের পোস্ট তার লিখন নিয়ে সেন্সরের কাঁচি চালানোর ক্ষমতা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের হাতে। গানের ক্ষেত্রেও কণ্ঠরোধের ক্ষমতা রয়েছে, সম্প্রতি বিজেপি প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়ের গাওয়া ভোটের গানের জন্য তাকে শো-কজ করার ঘটনা ঘটেছে। শোনা গিয়েছে বাবুল সুপ্রিয় নাকি বামফ্রন্টের স্লোগান ‘এই তৃণমূল আর না’ গানকে নকল করেই বিজেপি’র এই থিম সং তৈরি করেছিলেন। সেখানে তৃণমূলকে তথা মমতা ব্যানার্জিকে ব্যক্তি আক্রমণ করে তৈরি এই অ্যালবামে সংশোধন করার জন্য নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেই নির্দেশ না মানায় প্রথমে শো-কজ পর্যন্ত করা হয়েছিল বাবুল সুপ্রিয়কে। শেষ পর্যন্ত চাপের কাছে নতিস্বীকার করে এই গানটি গাওয়া বন্ধ হয়েছে বাবুলের।
অন্যদিকে বামফ্রন্টের ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে গান চুরি’র প্রতিবাদে লেখা হয়েছে একটি রঙ্গ কবিতা। তাতেই গান বাণে বিদ্ধ বাবুলই শুধু নয়, তার নেতা চৌকিদারও। তার কয়েকটা লাইন— কালো ধনের কলে, নোটবন্দির ফলে/একশো মানুষ মরে। তাহলে কাকা লাভ কার?/চুরি করেছে চৌকিদার। …চৌকিদার কি ঘুমিয়ে ছিল? নীরব ললিত পালিয়ে গেল?/তাহলে কাকা লাভ কার?/চুরি করেছে চৌকিদার… বেকার কৃষক শ্রমিক মরে, চায়েওয়ালা বিদেশ ঘোরে/তাহলে কাকা লাভ কার? চুরি করেছে চৌকিদার? দীর্ঘ গানের বেশ কয়েকটা লাইন শুনলেই বোঝা যায়। গানে গানে রাজনৈতিক তরজা কতটা জমেছে।
ভোটের প্রস্তুতি পর্ব হল প্রচার। সেই প্রচারের কী মহিমা সেকথা শরৎচন্দ্র পণ্ডিত (দাদাঠাকুর) বলে গিয়েছেন তাঁর ভোটাভিনন্দন রসরচনায়। সেখানে তিনি লিখেছেন, “হে সায়ত্ত্বশাসনের রাজন, হে ভোট, তুমি জমিদারকে দীনের দুয়ারে লইয়া যাও, শক্তিমানকে দুর্বলের করতলগত করাও…’।
এই যুগের কবি শ্রীজাতও লিখেছেন, “গ্রীষ্মকালে দৃশ্য চেনা, এক মাঘেতে সিট যাবেনা/তবু ভাষণ ভুষণ কনফিউশন, তুই যেদিক পারিস সেদিক ছোট/ফুল ফুটুক না ফুটুক, আজ ভোট… ।
দাদাঠাকুরের কালে ভোটের সময় জনসংযোগের একমাত্র উপায় ছিল বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট প্রার্থনা করা। ভোটের ভাষণে যে কম তরজা জমে না হাল আমলের নমো-মমোর জনসভা তার প্রমাণ। একে অন্যের প্রতি তির্যক মন্তব্যে খোলাখুলি আক্রমণে এ বলে আমায় দেখ তো, ও বলে আমায়। এ যদি বলে পাকিস্তানের বন্ধু তো ও বলে তুঘলকের ঠাকুরদা।
তবে শুধু আর মুখের কথায় নয় ভোটকে কেন্দ্র করে রঙ্গচিত্র বা ব্যঙ্গ ছড়ায় এখন ভোটের রঙ্গ জমে উছেছে। অন্তত এই রাজ্যে এই ব্যঙ্গের লক্ষ্য কিন্তু প্রধান দুই বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি। বিজেপির দেওয়াল লিখনে- ‘পরিবর্তনের এ কী গুণ, শিক্ষক চেয়ে ছাত্র খুন।…/রোজ রোজ নতুন ঢপ, শিল্প এখন আলুর চপ।

আবার পোস্টার আক্রমণে তৃণমূল লিখছে- পদ্ম গেছে শুকিয়ে, মরচে ধরেছে কাস্তে/ তৃণমূলকে ভোট দিয়ে মানুষ চাইছে বাঁচতে।’ শুধু ঘরের দেওয়াল কেন, এখন ফেসবুক ওয়ালেও ভোটের ব্যঙ্গচিত্রে বিরোধী নেতাদের ভার্চুয়াল লড়াইটা জমে উঠেছে। তৃণমূলের বেশ কয়েকজন নেতার দল ভেঙে বিজেপিতে যোগদান করাকে বিদ্রুপ করে বিজেপি ডাস্টবিনে দলত্যাগীদের কার্টুন রয়েছে তৃণমূলের পার্টি অফিসের বাইরে। গো রক্ষার নামে বিজেপি’র হিন্দুত্ব বাঁচানোকে কটাক্ষ করে গরুকেই ল্যাজ ধরে প্রার্থী করার আবেদন রাখা হয়েছে। মোদির নোটবন্দির আড়ালে নীরব মোদিদের হাত ধরে সব কালো টাকা বিদেশে পাচার করে দেশকে ক্যাশলেস করার রূপকার মোদি আর শাহকে কটাক্ষ করা হয়েছে কার্টুনে।
ভোটকে কেন্দ্র করে এই ব্যঙ্গচিত্র বা রসরচনা সাহিত্যের পর্যায়ে হয়তো পড়ে না। তবুও এইসব সৃষ্টি বলে দেয় নির্বাচনকে নিয়ে ‘বচনে কা দরিদ্রতা’।